Get the Latest News & Videos from News24 > খোলা বাতায়ন > অধর্মকে ‘ধর্মগ্রন্থ মনুসংহিতা’র উপর চাপিয়েছিল যাঁরা!

মনুসংহিতা-১ : মানবতা বিরোধী ঘৃণ্য এক গ্রন্থ : (১ম পর্ব ):
( রচনার প্রেক্ষাপট ও রচয়িতা )

অমলেন্দ্র সাহা: পৃথিবীর ইতিহাসে মনুসংহিতার মত এমন ঘৃণ্য ও মানবতা বিরোধী গ্রন্থ দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ । জন্মসূত্রে বর্ণ প্রথার উদ্ভাবক এ গ্রন্থের রচয়িতা যে কত নিকৃষ্ট ও পৈশাচিক মানসিকতার একজন মানুষ ছিলেন তা’ এ গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট হয়ে আছে । সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ও বিকৃত মানসিকতার উপর ভিত্তি করে মিথ্যা ধর্মের নাম দিয়ে সমাজের মানুষের মধ্যে প্রধানত: চারটি শ্রেণীতে উঁচু-নিচু বিভেদ সৃষ্টি করে প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে বংশ পরম্পরায় বা জন্মসূত্রে সেই বংশে শুধু সেই শ্রেণীর লোকই জন্মাবে বলে এক পৈশাচিক বিধান প্রণয়ন করা হয় এ গ্রন্থে যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোন স্থানে বা অন্য কোন ধর্মের নামে করা হয়েছে বলে জানা যায় না । এত বড় অনাচারকে একুশ শতকের ঘৃণ্য মানসিকতার ব্রাহ্মণ্যবাদীরাতো বটেই অধিকাংশ রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্যে এবং অধিকাংশ পারিবারিক বা ধর্মীয় মঠ-মিশনের গুরু / স্বামী / প্রভু / মহারাজরা স্বীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ উদ্ধারকল্পে জিয়িয়ে রাখছেন বা সমর্থন করছেন । এর প্রধান কারণ অবশ্য এ সকল রাজনৈতিক দলগুলো এবং নামধারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । প্রায় একই গাত্র বর্ণের, একই এলাকার প্রায় একই চেহারা সম্বলিত একই জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী লোকদের মধ্যে ধর্মের নামে বর্ণ ভেদের মত এমন নিকৃষ্ট প্রথা পৃথিবীর আর কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাবে না । পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী যত রকমের ঘৃণ্য প্রথা বিরাজিত তার ভেতর হিন্দুদের মধ্যে বিরাজিত মিথ্যা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদ নিকৃষ্টতম এবং ভয়ঙ্করতম পৈশাচিক ।

খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অন্চলের আদি নিবাসী পশুপালক নরডিক আর্যরা খাদ্যের সন্ধানে ইরান হয়ে ভারতবর্ষের পশ্চিমে প্রবেশ করে এবং ভারতবর্ষের আদি অধিবাসীদেরকে ( Sons of the soil ) পরাজিত করে ভারতভূমি দখল করে নেয় এবং তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদেরকে দাস হিসেবে বাস করতে বাধ্য করে । ভারতবর্ষের স্থানীয় অধিবাসীরা ছিল কাল গাত্র বর্ণের, উচ্চতা ছিল মাঝারী আকৃতির, নাকও ততটা সুউন্নত ছিল না । এ কারণে গৌর বর্ণের, উন্নত নাসার এবং উচ্চ দেহাকৃতির আর্যরা স্থানীয় অধিবাসীদেরকে ঘৃণার চোখে দেখতো । এর কয়েক শতক পর আর্যদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক মহান জ্ঞানী ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যাদেরকে আমরা ঋষি বলে জানি । তারা প্রথম দিকে আর্যদের কল্যাণের কথা চিন্তা করা শুরু করেন । পরবর্তীতে তারা সকল মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করতে শুরু করেন । সাধনা বলে প্রাপ্ত তাদের জ্ঞান মানব কল্যাণার্থে সকলের মাঝে প্রচার করতে থাকন । মহান ঋষিগণ মানুষের মধ্য বিভেদ সৃষ্টি না করতে এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার বাণী প্রচার করে যান । বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার পর তৎকালীন ঋষিদের মধ্যে অনেকেই আদর্শ চ্যুত হয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে তা’ প্রকাশ পেতে থাকে । ফলশ্রুতিতে রচিত হতে থাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাবধারার উদ্ভট ও গাঁজাখুরি কল্পকাহিনী নির্ভর পুরাণ, মহাকাব্য ইত্যাদি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণার্থে নানা স্মৃতিশাস্ত্র । এ সকল স্মৃতিশাস্ত্রের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ প্রভাবশালী সংযোজন হচ্ছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা – মানবতা বিরোধী মিথ্যা ধর্মের প্রামাণিক দলিল ।

মহাপবিত্র বেদকে নিয়ে যেমন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যুগে যুগে মিথ্যাচার করে এসেছে মনুসংহিতার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি । মনুসংহিতার রচনা কাল এবং রচয়িতার নাম নিয়ে বহু দিন তারা মিথ্যাচার করলেও এক সময় সত্য ঠিকই প্রকাশিত হয়ে পড়ে । খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চানক্য কৌটিল্যের সহায়তায় নন্দ রাজ বংশকে উচ্ছেদ করে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য স্বেচ্ছা অবসরে গেলে পুত্র বিন্দুসার মাত্র ২২ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন । খ্রিষ্টপূর্ব ২৭২ অব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে বিবাদ শুরু হয় । প্রথম জীবনে ত্রুর ও শঠ অশোক বিন্দুসার কর্তৃক মনোনীত উত্তরাধিকারী সুসীমকে ষড়যন্ত্র করে তার সুহৃদ রাধাগুপ্তের মাধ্যমে কৌশলে জ্বলন্ত কয়লার গর্তে ফেলে পুড়িয়ে হত্যা করেন । ধারনা করা হয় যে একমাত্র ভাই বীতাশোককে ছাড়া অন্য ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দে অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহন করেন । অশোক কর্তৃক ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করার অকাট্য প্রমাণ অবশ্য ঐতিহাসিকগণ আজ পর্যন্তও পাননি । দক্ষিণের সামান্য অংশ দাক্ষিণাত্য ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষ তার সাম্রাজ্যের অধীনে আনেন । অশোকের রাজত্বের ৮ম বছরে কলিঙ্গের যুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হন এবং অশোকের নিষ্ঠুরতায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ নির্বাসিত হন । এত মানুষের মৃত্যু এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অপরিসীম দু:খ-দুর্দশা দেখে নিষ্ঠুর অশোক বিচলিত হয়ে পড়েন এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হন । ইতোমধ্যে অশোক বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবান্বিত হন এবং যুদ্ধের ভয়াল রূপ ও কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় সম্রাট অশোক শান্তিকামী, অহিংস এবং প্রজাদরদী সম্রাটে প্ররিণত হন । সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম প্রীতি তার ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায় অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । তার প্রচারিত অহিংস নীতি বাস্তবায়নে তার সাম্রাজ্যে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় । এতে বলিদানের অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত মোটা অংকের দক্ষিণা থেকে বন্চিত হয়ে তথাকথিত ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের জীবন ধারণের অর্থাৎ আয়ের একটি বড় এবং সহজ উৎস হারায় । এমন সহজ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভীষণ রুষ্ট হন । শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্ম রাজানুকূল্য পাওয়ায় রাজ্যের সর্বত্র মানুষে মানুষে সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজে মানুষে মানুষে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ অর্থাৎ বর্ণভেদ উঠে যায় । তথাকথিত সকল বর্ণের মানুষের অধিকার ও বিচার একই মানদণ্ডের নিরিখে পরিচালিত হবে মর্মে রাজাদেশ জারী হয় । স্বঘোষিত ব্রাহ্মণরা বর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে প্রাপ্ত সকল অযৌক্তিক, অন্যায্য ও সহজলভ্য সুযোগ-সুবিধা এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বন্চিত হয়ে সমাজের সকল ক্ষেত্রে গৌণ ও অবহেলিত হয়ে পড়েন । ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে এটি ছিল একটি চরম চপেটাঘাত । ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় ছিল বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা । ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মনে মনে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হলেও তাৎক্ষণিকভাবে তার বহিপ্রকাশ ঘটাতে সাহস পাননি । খ্রিষ্টপূর্ব ২৩২ অব্দে অশোকের মৃত্যুর পর ৪৭ বছর পর্যন্ত দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মন, শতধনবান ও বৃহদ্রথ নামক ৬ জন মৌর্য সম্রাট রাজত্ব করেন । শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ মাত্র ২ বছর রাজত্ব করার পর প্রতিশোধপরায়ণ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পুন্জীভূত ক্ষোভের কারণে নিজ সেনা প্রধান বিশ্বাসঘাতক তথাকথিত সামবেদী ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে নির্মমভাবে নিহত হন । ক্রুর পুষ্যমিত্র সকল রীতি-নীতিকে পদদলিত করে অন্যায়ভাবে রাজ সিংহাসন দখল করেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সকল আকাঙ্খা পূর্ণ করতে ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আরো শক্তভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়ে উঠেন । এর ফলশ্রুতিতে রচিত হয় মনুসংহিতা নামক কুধর্মগ্রন্থ ।

বিশ্বাসঘাতক ব্রাহ্মণ্যবাদী পুষ্যমিত্র অন্যায়ভাবে রাজসিংহাসন দখল করেই সহযোগী সুমতি ভার্গবকে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রশস্তিমূলক এবং তথাকথিত ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব ও জন্মসূত্রেই তথাকথিত ব্রাহ্মণদের বর্ণ নির্দিষ্ট থাকার বিধান সম্বলিত গ্রন্থ রচনার নির্দেশ দেন । বহু ঐতিহাসিকগণের মতে সুমতি ভার্গব খ্রিষ্টপূর্ব ১৭০ – ১৫০ অব্দের মধ্যে মনু সংহিতা রচনা করেন । আবার আরেক দল ঐতিহাসিক মনে করেন যে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টপরবর্তী দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বছর ধরে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছে । দ্বিতীয় মতটি একেবারেই অবাস্তব বলে মনে হয় এবং প্রথম মতটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হয় । এ সকল ভণ্ড ব্রাহ্মণ্যবাদীরা চরম মিথ্যাচারের মাধ্যমে প্রচার করেন যে এ গ্রন্থটি প্রাচীন ঋষি মনু কর্তৃক রচিত । চরম বিভেদমূলক ও বিদ্বেষপ্রসূত মানবতা বিরোধী এ গ্রন্থটিকে সমাজে সহজ মান্যতা দিতে এবং এর প্রাচীনত্ব বুঝাতে এটি ঋষি মনু কর্তৃক রচিত বলে মিথ্যা প্রচারণা চালান হয় । এটি যদি ঋষি মনু কর্তৃকও রচিত হয়ে থাকে তা’ হলে মনুসংহিতার প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে এটি ভৃগু কর্তৃক রচিত বলে কেন উল্লেখ করা হয়েছে ? ভৃগু নামটিও একটি ছদ্মনাম । এটি যে একটি ভণ্ডামী ও প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণা তা’ একদিকে ঐতিহাসিকগণের গবেষণায় প্রমাণিত এবং অপর দিকে ‘নারদস্মৃতি’ ‘র গ্রন্থকার মনুসংহিতার আসল রচয়িতার নামটি প্রকাশ করে দিয়েছেন । এ গ্রন্থে নারী এবং শূদ্রদেরকে এতটাই পশুবৎ রূপে এবং হীন পর্যায়ের জীব হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যে পাষণ্ড পূষ্যমিত্র বা সুমতি ভর্গবরা সামাজিক বিদ্রোহের ভয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাতে বাধ্য হন ।

সূত্র : ১) ঋগ্বেদ, রমেশচন্দ্র দত্ত, হরফ প্রকাশনী ।
২) মনুসংহিতা, ড: মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায় শাস্ত্রী, শ্রীবলরাম প্রকাশনী ।
৩) 5 Main Causes of the Fall of the Mauryan Empire, Google.
৪) “মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণ, নারী ও শূদ্রের, স্থান” – সুধীর রন্জন হালদার ।
৫) “ অস্পৃশ্যনামা : না মানুষের পদাবলি” – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
— অমলেন্দ্র সাহা, ২২/০২/২০২১

হিন্দুদের ধর্মাচরণ ও পর্যালোচনার অবকাশ :

ধর্ম এ উপমহাদেশের মানুষের জীবনের অপরিহার্য বিষয় । উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও ধর্মকে বাদ দিয়ে যেন এক মুহূর্তও চলতে পারেন না । তাই বন্ধুবান্ধবদের মিলনমেলায় নানা গল্প আলোচনার একটি অংশ আবর্তিত হয় ধর্মকে ঘিরে । সেখানে না চাইলেও প্রায় সময়ই অংশ গ্রহণ করতেই হয় । শুধু সেখানেই নয় জীবন চলার পথে বহু জায়গায় ভিন্ন ধর্মী বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত জনদের কাছ থেকে মাঝে-মধ্যেই হিন্দুদের প্রচলিত ধর্মাচরণ সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক ( Negative ) ও ঠাট্টা-তামাশামূলক ( Funny ) কথা শুনতে হয় । শুধু তাঁরাই নন, হিন্দুদের মধ্যেও যারা মুক্ত চিন্তা করেন তারাও কিন্তু ঐ সকল ধর্মাচরণ নিয়ে প্রায় একই ধরনের ঠাট্টা-তামাশা করেন । প্রায়শ: যে সকল নেতিবাচক কথা শুনতে হয় তা’ সংক্ষেপে গুছিয়ে বলতে গেলে এ রকমটি হবে :
মানব জাতির মধ্যে হিন্দুরা এক বিচিত্র জীব ( A funny creature among the human race ) । তারা মুখে বলবে যে তাদের ঈশ্বর এক, কিন্তু অজস্র দেব-দেবীর পূজো করবে । হিন্দুদের দাবী অনুযায়ী প্রত্যেক দেব-দেবী ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ হলে সেই দেব-দেবীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হয় কি করে, সেই দেব-দেবীদের নিজেদের মধ্যে বিয়ে-সাদি হয় কি করে, তাদের সন্তান হয় কি করে অর্থাৎ দেব-দেবীদের মধ্যে কেউ কারো স্বামী, কেউ কারো স্ত্রী, কেউ ভাই, কেউ বোন, কেউ মামা ইত্যাদি হয় কি করে ? হিন্দুরা কেমন একেশ্বরবাদী ? আমি তাদেরকে এ কথাটা বুঝাতে চেষ্টা করি যে এ সকল দেব-দেবী পৌরাণিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মকে ভিত্তি করে সৃষ্ট । সনাতন ধর্ম বা বৈদিক ধর্ম এ সকল দেব-দেবীদেরকে এ ভাবে সমর্থন করে না । বৈদিক ধর্মে ঈশ্বর এক, তিনি নিরাকার, নিরবয়ব, সর্বশক্তিমান, জ্যোতির্ময় এক পরম দৈব সত্তা । বৈদিক ধর্ম ঈশ্বরের সাকার রূপকে সমর্থন করলেও তা’ পৌরাণিক ধর্ম ভিত্তিক সাকার রূপ থেকে ভিন্ন ।
তারা প্রশ্ন তুলেন যে হিন্দুরা জন্মের কারণে নিজেদের মধ্যে ছোট জাত-বড় জাত অর্থাৎ বর্ণভেদ ( Caste system ) সৃষ্টি করে নিয়েছেন এবং বংশ পরম্পরায় তা’ চলে আসছে । একই ধর্মের অনুসারী হয়ে এক বর্ণের ছেলে-মেয়ের সাথে অন্য বর্ণের ছেলে-মেয়ের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় না । তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বিধান । সবচেয়ে মজার এবং একই সাথে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে যে মানুষের মন-মানসিকতার বহুবিধ পরিবর্তন, বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি ও বিজ্ঞানের এমন অভাবনীয় উন্নতির যুগেও শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রায় সকল হিন্দুই আজো এ ঘৃণ্য প্রথা মেনে চলছেন । আমি তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করি যে হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ মহাপবিত্র বেদ-বেদান্ত বর্ণ প্রথাকে সমর্থন করে না । তারা পরিস্কার ভাষায় তখন বলে বসেন যে, যে ধর্মের বিধান শুধু ধর্মগ্রন্থের ভেতরে শৃঙ্খলিত সে ধর্মের কথা জানিয়ে কি কোন লাভ আছে ?
তারা জানান – হিন্দুদের বহু জনই তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম পর্যন্ত জানেন না । শুধু তাই নয় – হিন্দুদের অধিকাংশই তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ পড়াতো দূরের কথা, কোন দিন চোখে পর্যন্ত দেখেননি এবং এ নিয়ে তাদের মধ্যে সামান্যতম হীনমন্যতা বোধ বা অপরাধ বোধ বা কোন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হয় না । হিন্দুদের ধর্ম সভায় বা ধর্মালোচনায় কখনো তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ মহাপবিত্র বেদ-বেদান্ত নিয়ে বা সেই গ্রন্থের বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা হয় না । হিন্দুদের কোন আলোচনা সভায় বা ধর্মালোচনা সভায় অথবা কোন শুভ কাজের পূর্বে তাদের মূল ধর্মগ্রন্থ মপ. বেদ-বেদান্ত থেকে স্তোত্র পাঠ করা হয় না । এ কথাগুলো কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না । শুধু জানাই যে এক সময় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অন্যায়ভাবে রাস্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের জন্যে মপ. বেদ-বেদান্ত পাঠ ও শ্রবণ নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন এবং এর ব্যাত্যয় ঘটলে ধর্মীয়ভাবে পরকালে কঠোর শাস্তি এবং সামাজিকভাবে ইহ কালে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন । এ ভয়ে তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষদের মধ্য থেকে মপ. বেদ-বেদান্ত হারিয়ে যায় । আজো তারা এ ভয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি । তাই মপ. বেদ-বেদান্তের প্রচার-প্রচলন কম ।
ভিন্ন ধর্মী অনেক বন্ধু সনাতন ধর্ম বা বেদ-বেদান্ত সম্পর্কে কিছু জ্ঞান রাখেন । তাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জানাই যে হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ মপ. বেদ-বেদান্তের উচ্চ আধ্যাত্মিক দর্শন পৃথিবীর পণ্ডিত কূলকে চমৎকৃত করেছে । এ কথা জানালে তারা বলেন যে অধিকাংশ হিন্দুদের মধ্যেইতো তার কোন প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না । আমি তাদের এ কথা মানতে বাধ্য হই যে বর্তমানে হিন্দুরা বেদ-বেদান্তের ন্যায় উচ্চ আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে পরিহার করে পৌরাণিক ছেলে ভুলানো কল্পকথাকেই ধর্ম হিসেবে মান্যতা দিচ্ছেন । বন্ধুরা বলেন – সত্যি বিচিত্র তোমাদের মন-মানসিকতা । তোমরা পশু ও মানুষদেরকে অবতাররূপে অর্থাৎ ঈশ্বর স্বয়ং পশুরূপে বা মানুষরূপে এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে মনে করে তাদেরকে পূজো কর । কত নিম্ন শ্রেণীর চিন্তা তোমাদের মধ্যে কাজ করে !
বন্ধুরা আরো জানতে চান যে গুরুদেব বলে আরেক শ্রেণী হিন্দুদের মধ্যে বিরাজ করেন যারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবী করেন এবং তাদের শিষ্যরা তাদেরকে মান্যতা দেন । শিষ্যরা যাই করুন না কেন গুরুদেবদেরকে তুষ্ট করতে পারলেই নাকি কিল্লা ফতে – তাদের স্বর্গ নিশ্চিত । তোমরা তিন বেলা গুরুদেবের নাম জপ করলেই নাকি ঈশ্বরের উপাসনা হয়ে যায় । ঈশ্বরের পূজো না করলেও নাকি চলে কিন্তু গুরুর পূজো না দিলে নাকি নির্ঘাত নরকবাস । গুরুদেবরা এমন বিশ্বাসের সহজলভ্য সুযোগ নাকি হাত ছাড়া করেন না । বছরে দু’একবার কিছু দিনের জন্যে শিষ্যদের বাড়ী গিয়ে চর্ব-চূষ্য-লেহ্য-পেয় থেকে শুরু করে দেহ-মর্দন সকল আরাম-আয়েস ভোগ করে ফিরে যাবার সময় গাড়ী বা নৌকা ভর্তি চাল-ডাল-তেল-নুন এবং পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে যান । শিষ্যরা নাকি গুরুর কাছ থেকে স্বর্গ লাভের নিশ্চয়তা পেয়ে গুরুদেরকে সব কিছু উজার করে দিয়ে আনন্দে দিন কাটান ? কিন্তু সেই শিষ্যরাই দরিদ্র কোন লোককে সামান্য সাহায্য করতে গড়িমসি করেন । আমি তাদের কথার প্রেক্ষিতে জানাই যে তারা যা বলেছেন তার সব কিছুই সত্যি নয়, অনেক অতিরঞ্জন আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা পৌরানিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মভিত্তিক এ সকল অবতারবাদ ও গুরুবাদ সনাতন তথা বৈদিক ধর্ম সমর্থন করে না । তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে শিষ্যদের পাশের বাড়ীর কোন দরিদ্র ব্যক্তি অল্প কিছু টাকার জন্যে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পথ যাত্রী হলেও তারা সে দিকে তাকানো বা সাহায্যের হাত বাডানোকে মোটেও কর্তব্য বলে মনে করেন না, অথচ গুরুকে সর্বস্ব দিয়ে তুষ্ট করার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠেন ।
তারা আরো প্রশ্ন তোলেন যে হিন্দুরা সাপ-ব্যাঙ-গাছপালা-গরু-ছাগল ইত্যাদিকে পূজো করেন । তারা কালী পূজোতে শত শত পাঠা বলি দেন, কোন কোন স্থানে মহিষ বলি দেন , গরু বলি দিলেই ধর্ম চলে যায়, তাদের জীবে প্রেম উথলে উঠে । ভারতের আসাম অন্চলের কোন কোন স্থানের হিন্দুরা এবং দক্ষিণ ভরতের কোন কোন স্থানের হিন্দুরা গরুর মাংস খায় কি করে ? আমি জানাই যে হিন্দুরা ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট সকল কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরকে দর্শন করেন বলেই তারা প্রকৃতির সকল কিছুকেই শ্রদ্ধা করেন এবং এর মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন । আর বলির বিষয়ে তাদেরকে জানাই যে ধর্মের নামে বলি প্রথার আমি ঘোরতর বিরোধী । তবে আসাম এবং দক্ষিণ ভারতের অনেক হিন্দু গরুর মাংস খান কিনা তা’ আমার জানা নেই বলে জানালে আমার এক বন্ধু প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সচিব আমাকে নিশ্চিত করে জানালেন যে তিনি নিজে দক্ষিণ ভারত ভ্রমনে গিয়ে প্রকাশে হিন্দুদেরকে গরুর মাংস খেতে দেখেছেন এবং তাদের কাছ থেকে এ বিষয়টি জেনে নিশ্চিত হয়েছেন । তবে আমি নেপালে গিয়ে হতভম্ব হয়েছি যখন দেখেছি যে নাগরকোটের Hill Top হোটেলের ডাইনিং রুমে গরুর মাংস সার্ভ করা হচ্ছে । এ বিষয়ে আমি জিজ্ঞাসা করে জেনে অবাক হয়েছি যে হোটেলের মালিক থেকে শুরু করে প্রায় সকল স্টাফই হিন্দু ।।
এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি বন্ধুদেরকে জানাই যে, আমি ঐ সকল পৌরাণিক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম ভিত্তিক ধর্মাচরণ পছন্দ করি না এবং মানিও না, আমি বৈদিক ধর্ম পালন করতে চেষ্টা করি । বৈদিক ধর্মে এ সকল অনাচার নেই । তাই যারা এ সকল আচার মানেন তাদের কাছ থেকে এ সকল প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়ার জন্যে পরামর্শ দেই । আমি শুধু জোর দিয়ে এ কথাটাই জানাই যে সনাতন ধর্ম এ সকল অনাচার সমর্থন করে না ।
আসলে আমি নিজে হিন্দু হয়েও হিন্দুদের মন-মানসিকতা যথার্থভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হই না । তারা নিজেদেরকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে দাবী করেন । কিন্তু তারা কি আদৌ সনাতন ধর্ম তথা মপ. বেদ-বেদান্ত ভিত্তিক ধর্ম অর্থাৎ বৈদিক ধর্ম পালন করেন ? বৈদিক ধর্ম অর্থাৎ মপ. বেদ-বেদান্তের বিধি-বিধান “ওঁ”-কে পরমেশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানাম হিসেবে ঘোষনা করেছে এবং “ওঁ তৎ সৎ”-কে সর্বশ্রষ্ঠ মহামন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছে । আমরা ক’ জন তা’ মানি এবং ক’ জন সারা দিনে এক বারের জন্যেও এ মহানাম এবং মহামন্ত্র জপ করি ?
ধর্ম হচ্ছে মানবতার শিক্ষা গ্রহণের প্রথম পাঠ । নাস্তিকগণ বলে থাকেন যে মানুষ ধর্ম ছাড়াও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে । নাস্তিকগণের কথাকে অস্বীকার না করলেও এ কথা জোর দিয়েই বলা যায় যে প্রাচীন কালে ধর্মই মানুষকে সভ্যতার পথ দেখিয়েছে এবং সুন্দরভাবে জীবন যাপনের দিক নির্দেশনা দিয়েছে । প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ঋগ্বেদে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে – “ তোমরা সকলে একত্রে মিলিত হও, তোমরা সকলেই একরূপ হও, তোমরা সকলে এক প্রাণ হও, এক মন হও, সকলে সম্মিলিতভাবে মন্ত্র উচ্চারণ কর, তোমরা যেন সকলে সর্বাংশে একমত হও ।” ( ১০/১৯১/২-৪ ) । ঋগ্বেদের ৫/৬০/৫ নং মন্ত্রে সাম্যের মহান বাণী বর্ণিত হয়েছে – “ তোমাদের মধ্যে কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয় ”, ৬/৭৫/৯ নং মন্ত্রে বর্ণিত হয়েছে – “ সমাজকে ভালবাস, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও, দুর্গতকে সাহায্য কর “, ৪/২৩/৭ নং মন্ত্রে বলা হয়েছে – “ যারা সৎ পথে পরিশ্রম করে এবং পরস্পরের সাহায্য করে তারা ঈশ্বরের কৃপা ধন্য “, ৫/১৫/৩ নং মন্ত্রে ঘোষনা করা হয়েছে – “ সৎ কর্ম মানুষকে দৃঢ়চেতা ও সাহসী করে ।” ধর্মের এ সকল বক্তব্য কি মানবতার বক্তব্য নয় ? মানুষকে সত্যের পথে, জ্ঞানের পথে তথা সভ্যতার পথে অগ্রসর হতে উৎসাহিত করার জন্যে উপনিষদে ( তৈত্তিরীয় উপনিষদ : ২/১/২ ) সত্য এবং জ্ঞানকেই পরমেশ্বর রূপে বর্ণনা করা হয়ছে ।
ধর্ম হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্যে, মানুষের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপনের জন্যে এবং সুদৃঢ় করার জন্যে এবং মানুষকে নৈতিক ও আদর্শের পথে, মানবতার পথে, জ্ঞান ও সত্যের পথে তথা সভ্যতার পথে পরিচালিত করার জন্যে । দুর্ভাগ্য যে সনাতন ধর্মের নাম করে স্বার্থবাদীরা বিকৃত ধর্ম বাজারজাতকরণের মাধ্যমে সমাজকে প্রতারিত করে চলেছে । সমাজের মানুষের মনে বর্বর ও পশ্চাৎমুখী চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে দিচ্ছে । সমাজের মানুষের মধ্যে কুৎসিত ও ঘৃণ্য বিভেদ এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে । বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ বা সুযোগ আছে কিনা তা’ অনুধাবন বা পর্যালোচনা করার সময় এসেছে ।

— অমলেন্দ্র সাহা, ০৪/০২/২০২১ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *